ইন্দ্রের আসনে আরোহীরা


দেও টিব্বা র শিখরে
  দিন টা ছিল ২৮এ মে ২০২২,প্রায় ১হাজার কেজি মাল পত্র নিয়ে আমরা হাজির হলাম হাওড়া স্টেশন এর সেই সবার পরিচিত বিখ্যাত বড়ো ঘড়ির সামনে,আমাদের এবারের অভিযান পীরপঞ্জাল রেঞ্জ এর দুটো পিক মাউন্ট ইন্দ্রাসান ও মাউন্ট দেও টিব্বা। আমি (দেবাশীষ মজুমদার) আরোহীর এবছরের নতুন সদস্য, আগে অনেকের মুখেই শুনেছিলাম সোনারপুর আরোহী এমন একটা ক্লাব যেখানে ২০জন এক থালায় খেতে পারে, কথা টা যে নিছক ই’ কথার কথা’ নয় তা এবার স্বচক্ষে দেখলাম। সেদিন আমরা শুধু ১১জন অভিযাত্রী নয়, আরোহীর বেশিরভাগ সদস্যই আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এসেছে। তাছাড়া আমাদের এই অভিযানে অনেকে পাহাড় প্রেমী মানুষেরাই অর্থ সাহায্য করেছেন, এমন কি DVC এবং WBSEDCL এর মতো সরকারি সংস্থাও আমাদের আর্থিক সাহায্য করেছে। রানাদা, অভিজিৎদা, অভিক ও আর কিছু ক্লাব সদস্য সকালে মা বিপদ তারিনির পুজো দিয়েছিল অভিযাত্রী সদস্য দের মঙ্গল কামনায়। মা এর পায়ে ছোঁয়ানো সেই  ধাগা অভিজিৎ দা সবার হাতে পরিয়ে দিল । চললো ক্লাবের ব্যানার নিয়ে ফটো সেশন, নির্দিষ্ট সময়ে সবাই কে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো আমরা ১১ জন-
১-রুদ্র প্রসাদ হালদার (টিম লিডার)     
২- পার্থ সারথি লায়েক (ডেপুটি টিম লিডার)
৩- সত্যরূপ সিদ্ধান্ত (টিম ম্যানেজার)
৪- নৈতিক নিলয় নস্কর (ইকুইপমেন্ট ম্যানেজার)
৫- রুদ্র প্রসাদ চক্রবর্তী (কোয়াটার মাস্টার)
৬- জীবন লাল মল্লিক (আকাঊণ্টেণ্ট)
৭- দেবাশীষ মজুমদার
৮-কল্যানাসিস চৌধুরী 
৯-নবীন চৌধুরী
১০-শেখ ওমর ফারুক
১১- সাফিয়ার রহমান
১১ জনের এমন একটা দল যারা একটা মাস ঘর ছেড়ে, প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য ছেড়ে পাহাড় এর সাথে একাত্ম হয়ে একসাথে হেসে খেলে কাটিয়ে দিলাম। বুঝতেও পারলাম না কখন যেন দিন গুলো খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেলো। ২৯এ মে গোটা দিন টা কেটে গেলো ট্রেন এ খাওয়া দাওয়া সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে। ৩০ তারিখ ভোর-রাত প্রায় তিনটে নাগাদ ট্রেন পৌঁছালো চণ্ডীগড় স্টেশন এ।একটি ট্রাভেলার গাড়ি আমাদের অপেক্ষাতে ছিল আগে থেকেই স্টেশন এর বাইরে,গাড়িতে সব জিনিষপত্র তুলতে লেগে গেলো প্রায় ১ঘণ্টা।এত শারীরিক কসরতের পর শরীর কেমন চা-চা করছে ।পেটে গরম চা পড়তেই শরীর আবার চনমনে। গাড়ি ছুটলো মানালির উদ্দেশ্য যেখানে আমাদের বাকি ৫ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অপেক্ষায় আছে । ফুরসেম্বা শেরপা, নরবু শেরপা, বিরে তামাং, সুলডিম শেরপা, সোনাম তামাং। যাদের ছাড়া দুর্গম পাহাড়া আমরা অনেকই অসহায় বোধ করি। ফুরসেম্বা শেরপা সর্দ্দার।  

  দিনটা গাড়িতেই কেটে গেলো আমাদের।বিকেল তখন প্রায় ৪টে কুলু তে পৌঁছে শেষ অফিসিয়াল কাজ সেরে আবার গাড়িতে মানালি পৌছতে ৬টাবেজে গেল। গাড়ি থেকে নামতেই আমাদের শেরপা ভাইদের উষ্ণ অভ্যর্থনা মন ভরিয়ে দিল। আমরা যারা এক্সপিডিসান এ যাই মানালি তে নীলকমল হোটেল টাই বেছে নি, তার একটা অন্যতম কারণ হলো নীলকমল এর ছাদ টা আমরা পুরোটাই ব্যাবহার করতে পারি, সেখানে রান্না, করা ছারাও মাল পত্র গুছনো ও রি প্যাকিং সব টাই নিজের মত করে গুছিয়ে নিতে পারি।
     ৩১ শে মে সকাল থেকে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। কাঁচাবাজার সেরে নেওয়ার পাশাপাশি চলছে সেদিনের রান্না, প্যাকিং ।সব কাজ সেরে আমি পার্থদা আর নৈতিক প্রেয়ার ফ্ল্যাগ নিয়ে সামনের মনেস্ট্রি তে পুজো দিয়ে এলাম যা আমাদের বেস্ ক্যাম্পের মন্দিরে টাঙ্গানো হবে। রাতে শেষবারের মতো গুছিয়ে নেওয়া হলো নিজেদের স্যাক। তাড়াতাড়ি শোয়ার পরিকল্পনা থাকলেও হাসি ঠাট্টা গল্প শেষ করে শুতে শুতে সেই দেরি।
      ১লা জুন ভোর পাঁচটার মধ্যেই হোটেলের সামনে গাড়ি হাজির। সমস্ত জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে নিজেরাও গুছিয়ে বসলাম। গাড়ি ছাড়লো, গন্তব্য জগত সুখ ড্যাম। সকাল সাতটায় গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল কিন্তু তখনও আগে থেকে বলে রাখা দশটা খচ্চর ও তাদের মালিকের দেখা নেই। সময় নষ্ট না করে শেরপাড়া রান্না চাপিয়ে দিল। খাওয়া দাওয়া গল্প চলছে, এসবের মাঝেই খচ্চর ওয়ালারা এসে উপস্থিত। অগত্য তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। প্রথম দিনের ট্রানজিট ক্যাম্প চিকা তে। জিনিসপত্র নামিয়ে তাবু পাতা হল জগৎসক নদীর ধারে। শহরের ব্যস্ততা কে পিছনে ফেলে শান্ত নিরিবিলি জগৎসুখ নদীর পাড়ে মন ভরানো পরিবেশে আজ আমাদের রাত্রি বাস। একটানা নদীর কলতান মন উদাস করে দেয়। এখানে বলে রাখা ভালো মানালি থেকে যে কেউ একদিনের ট্রেক করে চিকাতে এসে থাকতে পারে।
       ২রা জুন সকাল আটটার মধ্যে জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম পরবর্তী ট্রানজিট ক্যাম্প সেরির উদ্দেশ্যে। শুরু হলো পথ চলা ।প্রকৃতির অকৃপণ ভালোবাসায় সেজে উঠেছে সেরি। পাখির গান, গাছপালার গল্প, আর নদীর কথা শুনতে শুনতে আমরা চলেছি সেরির পথে। প্রায় দুপুরের পর পৌঁছালাম ক্যাম্পে।
      ৩রা জুন আমাদের আজকের লক্ষ্য বেস্ ক্যাম্প এ যা ছোট চন্দ্রতাল লেক এর ঠিক পাশে। প্রায় ৬-৭ ঘন্টায় আমরা এসে পৌঁছে গেছি বেস্ ক্যাম্পে। সেখানে খচ্চর ওয়ালা ও তিনজন পোটার ভাইকে বিদায় জানানো হলো। এখানেই থাকবে আমাদের ১৮-২০ দিনের সংসার। তৈরি হলো পাথর দিয়ে মন্দির, রান্নাঘর । চন্দ্র তলের জল দিয়েই রান্নাবান্না ও অন্যান্য জলের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে নিতাম আমরা।
      ৪ঠা জুন সম্পূর্ণ দিন আমরা বিশ্রাম করলাম বেস্ ক্যাম্পে। সেদিনটা শুরু হলো গোছগাছের পালা । ওপরের ক্যাম্পে লোড ফেরি হবে তার জিনিসপত্র গোছানোর মাঝেমাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে দূরে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা ধোয়াঙ্গন কলের দিকে। কলের ওপরেই পড়বে আমাদের ক্যাম্প ওয়ান এর তাবু। 
ধূয়াঙ্গন কলের দেয়াল থেকে বেস ক্যাম্প 
      ৫ই জুন আবার শুরু হল এক প্রস্থ গোছগাছ কারণ পরের দিন শেরপার রওনা দেবে ইন্দ্রাসন ও দেওটিব্বা র পথে রোপ ফিক্স করতে। সঙ্গে চলবে লোড ফেরি।
৬ই জুনআমাদের ৫ জন শেরপা  সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লেন ক্যাম্প ১ এর উদ্দেশে পিঠে আস্ত বড়ো স্যাক নিয়ে। আমরাও বেরোলাম লোড ফেরি করতে।সেদিন দুপুর থেকেই আবহাওয়া খারাপ হতে থাকলো।আমরা ক্যাম্প ১ এ লোড ফেরি করে নিচে নেমে এলাম।আর শেরপা রা সেদিন ক্যাম্প ১এই থেকে গেলো। ধুয়াঙ্গণ কলে আমাদের শেরপা রা রোপ ফিক্সড করেই রেখেছিল আমাদের সুবিধার্থে। ধুয়াঙ্গন কলের উচ্চতা ৫০৫০ মিটার। বেস কয়েক দিন চললো লোড ফেরি।এদিকে শেরপাদের সাথেও ওয়াকী টকি তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো আমাদের।ওরা আরো ওপরে উঠে গেছে।অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই তাই শেরপাদের নিচে আসার অপেক্ষা করতে থাকলাম।
  ৭ই জুন থেকে ৯ই জুন আমরা বেশ ক্যাম্পেই কাটালাম। হাতে হাতে কাজকর্ম আর তার সাথে চলল নানান গল্প। তিন দিনের বেস কাম্প পিলু দার গান আর ওমরদার গানে মুখরিত হয়ে রইল। সাথে চলল লুডো খেলা আর তাসর আড্ডা। শেরপা দের আসার প্রহর গুনতে গুনতে এভাবেই নিজেদের ব্যস্ত রেখে কাটলো আমাদের তিনটে দিন।
      ১০ই জুন শেরপা ভাই রা বেস ক্যাম্প এ ফিরে এলেন।প্রচন্ড খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই ওরা ইন্দ্রাসন এর প্রায় অর্ধেক এর বেশি রুট ওপেন করে নিচে নেমে এসেছেন। শেরপা দের মুখে ইন্দ্রাসন রুটের গল্প শুনে আমাদের অনেকেরই চক্ষু চড়কগাছ। রোপ ফিক্সড করতে গিয়ে ওপর থেকে রক ফল হয়ে বীরে ভাই এর হেলমেট ভেঙে চুরমার। 
     ১১ই জুন গোটা টিমের রেস্ট ডে। সেদিন সন্ধ্যায় শেরপা সর্দার ফুরসেম্বা জি জানালেন ওপরে ইন্দ্রাসন এর যা কন্ডিসান তাতে ৫জন শেরপা র সাথে ৫জন মেম্বার ই ওপরে যেতে পারবেন।আমাদের লিডার রুদ্র প্রসাদ হালদার দা ফুরসেম্বা জি কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন যে আমরা ৫জন নয় ৭জন ইন্দ্রাসন ক্লাইম্ব করতে যেতে চাই, সেরকম হলে পরিস্থিতি বুঝে দুজন না হয় সামিট ক্যাম্প এ থেকে যাবে। রাতে মিটিং এ বসা হলো দলের ১১জন সদস্য দের নিয়ে। মিটিং এ ঠিক হলো দলের ৪ জন সদস্য বেস ক্যাম্প এ থাকবে।জীবন লাল মল্লিক, কল্যনাসিস চৌধুরী, নবীন চৌধুরী আর সাফিয়ার রহমান। বাকিরা ইন্দ্রাসন ক্লাইম্ব করে ফিরবে তারপর একসাথে গোটা টিম দেও টিব্বা ক্লাইম্ব করতে যাবে। এই ছিল আমাদের সেই রাতের প্ল্যান।
     ১২ই জুন আমাদের ৭জনের দল ৫শেরপা নিয়ে ক্যাম্প ১ অকপায়েড করার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।বেস ক্যাম্প থেকে ধুয়াঙান কলের ঠিক পায়ের গোড়ায় যেতে লেগে যেতো প্রায় দেড় ঘণ্টা।আর কলের মাথায় উঠতে আরো ৩ঘণ্টা।আমরা কলের ঠিক ওপরের আইস ফিল্ডে ক্যাম্প ১ এ সেদিন রাত টা কাটিয়ে দিলাম।
    ১৩ই জুন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ক্যাম্প ২ এর উদ্দেশ্যে।গোটা আইস ফিল্ড টা কে ডান দিকে রেখে সবাই রোপ আপ এর মাধ্যমে হাঁটতে থাকলাম, তখনও বুঝি নি সামনেই একটা বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিছুটা যেতেই হিডেন ক্রিভাস এ বুক অব্দি ঢুকে গেলাম আমি।যেহেতু সবাই রোপ আপ এ ছিলাম তাই কোনো ক্ষতি হলো না, কোনো রকমে শরীর টা কে পুরো বরফের মধ্যে শুয়ে দিয়ে নিজেকে বার করলাম।খানিক টা পাশ কাটিয়ে আসতে গিয়ে সত্যরূপ দা ও ঢুকে গেলো কৃভাস্ এ, তারপর আমাদের 
শেরপা ভাই বীরে সেও ঢুকে গেলো।অনেক কষ্ট করে একে ওপরের সাহায্য নিয়ে আইস এক্স গেঁথে তারওপর বসে আইস এক্স এ এনকার করে বিলে দিয়ে উদ্ধার কার্য চললো।বুঝলাম ওই জায়গা টা পুরোটাই হিডেন কৃভাষ এ ভরা।এরপর শুরু হলো আর এক যুদ্ধ।সামনেই একটা বরফের দেয়াল।সেখানে আগে থেকেই আমাদের শেরপা ভাই রা রোপ ফিক্সড করে রেখেছিল।প্রথমে ৩০থেকে ৪০ডিগ্রি গ্রেডিয়েন্ট দিয়ে শুরু হলো ক্লাইম্ব।তারপর আসতে আসতে শেষ ১০০মিটার তো প্রায় ৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি ওয়াল এ পরিনত হলো।ওয়ালের ওপরের দিকে যত গ্রেডিয়েন্ট বাড়তে থাকলো লুস স্নো ততই কমতে থাকলো।একটা সময় হার্ড আইস এ কোনো রকম এক হাতে জুমার ঠেলে আর এক হাতে আইস এক্স মেরে স্নো বুটের ফ্রন্ট পয়েন্ট মারতে মারতে ক্লাইম্ব করতে হলো।আইস ওয়াল ক্লাইম্ব করে উঠতেই শেরপা সর্দার জানালো আজ আমরা ক্যাম্প ২নয় ক্যাম্প সোজা ক্যাম্প ৩ তে গিয়ে তাঁবু ফেলবো।

ইন্দ্রাসন সামিট ক্যাম্প 

এখানে একটু বলেনি, ক্যাম্প ২ আর ক্যাম্প ৩হলো একটা বিশাল আইস ফিল্ড এর এপার আর ওপার।ক্যাম্প ২হলো দেও টিব্বার সামিট ক্যাম্প আর ক্যাম্প ৩হলো ইন্দ্রাসন এর সামিট ক্যাম্প। ওখানেই আমরা প্রথম সেই ভয়ংকর সুন্দর ভগবান ইন্দ্রের আসন মানে ইন্দ্রাসন আর মায়াবী দেও টিব্বার দখা পাই। যাই হোক, শেরপা সর্দার এর কথা মত আমরা ক্যাম্প ২ কে পিছনে ফেলে ক্যাম্প ৩এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।ক্যাম্প ৩তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে ৬টা বেজে গেলো। সেই রাতেই মিটিং এ ঠিক করা হলো আমরা কাল অর্থাৎ ১৪ই জুন রাত ১০টায় আমরা ১৪ই জুন সকাল থেকে সারাদিন রেস্ট নিয়ে স্যাক গুছিয়ে রেডি করে রাখলাম। এদিকে বীরে ভাই আর নরবু জি গেলো ইন্দ্রাসন এর বরফে চাপা পড়ে থাকা ফিক্সড রোপ গুলো টেনে তুলতে আর বাকি সামিট অব্দি রোপ ফিক্সড করতে।ওদের ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেলো।বীরে ভাই ক্যাম্প এ পৌঁছেই জানালো যে সে আজ রাতে সামিট এ আমাদের সাথে যেতে পারবে না।আর নোরবু জি দু ঘন্টা রেস্ট নিয়ে পড়ে বেরোবে।রাত ৮টায় ডিনার সেরে সামিট পুসের জন্য সাজ গোজ শুরু করে দিলাম। সোনাম, ফুরসেম্বা আর সুলডিম জি কে সাথে নিয়ে আমরা ৭জন ক্যাম্প থেকে বেরোতে 

বেরোতে রাত ১১টা হয়ে গেলো। হেড টর্চ জ্বালিয়ে ক্যারাবিনারের ঠুং ঠাং শব্দ আর বরফের মচ মছ শব্দ করতে করতে এগিয়ে চললাম ইন্দ্রাসনের দিকে।সেদিন রাতে জোৎস্নার আলোয় গোটা আইস ফিল্ড আলোকিত। আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ইন্দ্রাসনের পায়ের গোড়ায়। ফিক্সড রোপ এ জুমার লাগিয়ে শুরু হলো ক্লাইম্বিং। শুরু টা ঠিক ঠাক ই ছিল ৪০থেকে ৬০ ডিগ্রি গ্রেডিয়েন্ট এ ক্লাইম্ব হচ্ছিল। এই ভাবে ঘণ্টা দুয়েক চলার পর এক জায়গায় ট্রাভার্স করতে হলো। ট্রাভার্স করেই ফিগার অফ এইট ডিসেন্ডার এর মাধ্যমে ডিসেন্ড করে আবার শুরু হলো ক্লাইম্বিং।নিচে দূরে দেখতে পেলাম একটা হেড টর্চ এর আলো আমাদের টেন্ট থেকে ইন্দ্রাসনের দিকে এগিয়ে আসছে।বুঝলাম নড়বু জি আসছেন।খানিকটা চলার পর ফুরসেম্বা বললেন ইয়াহা সে জলদি নিকালনা পারেগা। রুকো মাত চালতে রাহো।ওপর দিকে তাকাতে দেখলাম বিশাল একটা আইস স্যারাক,যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।আমাদের ক্লাইম্বিং স্পিড বাড়িয়ে দিলাম।তখন হওয়ার গতিবেগ ও বেশি।মনে হচ্ছে সাওয়ার এর নিচে দাড়িয়ে আছি আর সাওয়ার থেকে ঝুরো বরফ সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। হেলমেট এর পিছন থেকে ঘাড়ে বরফ ঢুকছে,পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঠান্ডায়। কোনরকমে তাড়াতাড়ি ওই এলাকা টা ক্রস করলাম।হঠাৎ চোখ পড়লো দেও টিব্বার দিকে। ভোরের প্রথম কিরণ  দেও টিব্বাকে লাল করে তুলেছে। আসতে আসতে গোটা আইসফিল্ড টাও লাল হতে থাকলো।অসম্ভব সুন্দর সেই দৃশ্য।সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ক্লাইম্বিং চলতে থাকলো।একটা সময় একটা প্রায় ৯০ডিগ্রি খাড়া পাথরে দেয়াল এর সামনে এসে দাঁড়ালাম।বুঝতে পারলাম এখান থেকেই শুরু হয় ইন্দ্রাসন ক্লাইম্বিং এর আসল খেলা।একপ্রকার যুদ্ধ করে শুরু হলো রক ওয়ালে ক্লাইম্বিং। ক্রাম্পন পড়ে রক ওয়ালে ক্লাইম্বিং সত্যি খুব চাপের। এখানেই সত্যরূপ দার ফেদার জ্যাকেট ছিঁড়ে যায়।হ্যান্ড গ্লাভস পরে যায় নিচে। তবু সত্যরূপ দা হাল ছাড়ে না। রক ওয়ালে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে।একটা সময় শরীরের ভারে জুমারের দাঁত রোপের ওপর চেপে বসে যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা যুদ্ধ করার পর সত্যরূপ দা ডিসিশান নেয় যে সে নিচে নেমে যাবে।আমরা বাকি ৬জন ওপরের দিকে উঠতে থাকলাম।এখানেই শেষ নয় আবার একটা চিমনি র সামনে এসে দাড়ালাম। চিমনির ফাটল টা এতো টাই সরু যে একজন রোগা মানুষ ও সেই ফাটলে আটকে যাবে।অগত্যা স্যাক নিচে রেখে ক্লাইম্ব করতে হলো। ওপরে উঠে স্যাকে ক্যারাবিনার লাগিয়ে রোপ দিয়ে টেনে স্যাক ওপরে তোলা হলো।কাল রাত থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বসার জায়গা পাইনি।চিমনির ঠিক ওপর টা তেই একজনের মত একটা বসার জায়গা পেলাম।সেখানে স্যাক থেকে কিছু চকলেট বার করে খেলাম, আর জল খেলাম।
তারপর কিছু টা উঠতেই আবার একটা রক ওয়াল। কোনরকম হ্যাচর প্যাচর করে সেটা কে ক্লাইম্ব করে উঠে এলাম একটা প্রায় ৭০ডিগ্রি আইস ওয়ালের সামনে। সেটা ক্লাইম্ব করে উঠতেই বুঝলাম আসল বাঁধা গুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি। এরপর খানিকটা নরমাল মার্চিং করে ওপরে উঠে আসতেই দুর থেকে সামিট দেখতে পেলাম, তখনও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ক্লাইম্ব করলে তবেই সামিটে পৌঁছাতে পারবো আমরা।সামিটের ঠিক ১০০মিটার নিচে একটা হাম্পের ওপর এসে দাড়ালাম আমরা।সামনেই একটা ছোট্ট বার্গসুন্ড পেরিয়ে প্রায় ৬০ডিগ্রি গ্রেডিএন্ট ধরে উঠতে থাকলাম সামিটের দিকে।
  ১৫ই জুন সকাল ১০:২০ টিম আরোহী সাথে ৪শেরপা ভাই মাউন্ট ইন্দ্রাসনের সামিটে।একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম। তোলা হলো সামিটের গ্রুপ ছবি।প্রায় ৪৫মিনিট পর আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।নিচে সেই হাম্পের ওপর নেমে একটু বসলাম সবাই মিলে।স্যাক থেকে বিস্কুট, 
ইন্দ্রাসনের শিখরে
চকলেট বার করে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হলো।আমদের খেতে খেতেই আবহাওয়া খারাপ হতে থাকলো।ফুরসেম্বা জি বললো আর দেরি করা যাবে না এবার নিচে নামতে হবে।শুরু হলো স্নো ফল সাথে হোয়াইট আউট।অতি সন্তরপনে ডিসেন্ড করতে থাকলাম। সন্ধ্যে ৬টা একপ্রকার টলতে টলতে বিদ্ধস্ত অবস্থায় সামিট ক্যাম্প এ ফিরলাম।শরীরে আর একফোঁটা ও শক্তি নেই।রাতে খেয়ে টানা ঘুম দিলাম সবাই।
    ১৬ই জুন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার হয়ে রয়েছে। এদিকে সুলডিম জি আর সোনাম আজ ই নিচে বেস ক্যাম্পে নেমে যাবে জীবন দা,কল্যানাসিস দা,নবীন দা আর সাফিয়ার কে ক্যাম্প ১এ পৌঁছে দিয়ে একজন নেমে যাবে আবার বেস ক্যাম্পে। নরবু জি আর সোনাম এর মধ্যে যে কোনো একজন বেস ক্যাম্পে থেকে যাবে আর একজন ওদের ৪জন কে নিয়ে ওপরে উঠে আসবে এই ছিল আমাদের প্ল্যান।দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া এত টাই খারাপ হতে থাকলো যে আমাদের প্ল্যান বদলে গেলো।ঠিক হলো সেদিন রাতেই আমরা দেও টিব্বা সামিটের করে ক্যাম্প ১এ নেমে যাবো। এদিকে দেও টিব্বা তে রোপ ফিক্সড টাও হয়ে থাকলো তাহলে দ্বিতীয় দলের সামিট করা টা সুবিধা ও হবে।                                   
      ১৭ই জুন ভোর তিনটের সময় নিজেদের সমস্ত মাল পত্র স্যকে ভরে বীরে কে সাথে নিয়ে আমরা ৭জন ক্যাম্প ২ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, সকাল ৬টার মধ্যেই ক্যাম্প ২এ এসে দেখি সেখানে বরফ খুঁড়ে একটা বড় গর্ত করে রাখা আছে। বীরে বললো কিচেন করবে বলে আগের দিন ওই গর্ত করা হয়েছে।যাই হোক সেই গর্তে সবার এক্সট্রা জিনিষ ডাম্প করে বেরিয়ে পড়লাম দেও টিব্বার দিকে। দলনেতা রুদ্র দা জানালেন আমরা শেরপা ছাড়াই নিজেরা রুট ওপেনের চেষ্টা করবো। সেই কথা মতো রোপ আপ এর মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চললাম। আর বীরে ভাই রইলো সবার পিছনে। আসতে আসতে আবহাওয়া ভয়ানক হতে থাকলো, ভিসিবিলিটি একদম জিরো হয়ে গেলো।আমরা তখন দেও টিব্বার পা এর কাছে।বুঝলাম এই খারাপ আবহাওয়া র মধ্যে রুট ওপেন করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তখন রুদ্র দা বীরে  কে এগিয়ে এসে রুট ওপেন করতে বললো।প্রায় দুশো মিটারের আইস ওয়াল ৭০ ডিগ্রি গ্রেডিয়েন্ট ধরে ক্লাইম্ব শুরু হলো।ক্লাইম্ব করতে করতে যা মনে হলো এই রুটে আমরাই হয়তো প্রথম কারণ একটা ৭০ডিগ্রি গ্রেডিয়েন্ট এর দুশো মিটারের  আইস ওয়াল আর সেখানে কোনো পুরনো রোপ বা স্নো স্টিক বা স্নো পিটন কিছু তো থাকবে।যেখানে এতবার ক্লাইম্ব হয় দেও টিব্বা।আর যেখানে আমরা প্রত্যেকেই জানি দেও টিব্বা একটা মার্চিং পিক সেখানে এরকম একটা খাড়া দেওয়াল ধরে ক্লাইম্ব হচ্ছে।

দেও টিব্বার দেয়ালে 
যাইহোক নিচ থেকে নোরবু জি এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো, দুশো মিটারের খাড়া দেওয়াল ক্লাইম্ব করে একটা সহজ ঢালে এসে দাড়ালাম আমরা,রোপ আপের মাধ্যমে চলতে থাকলাম আমরা,সামনে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না আমরা।অন্ধকারে হাতড়ে বেরানোর মতো সামিট খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা। নোরবু জি হাঁটু গেরে বরফের মধ্যে বসে নিচু হয়ে সামিট এর রাস্তা দেখার চেষ্টা করছে।নৈতিক ডেলোরমে হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।বার বার ডেলোরমে তে উচ্চতা চেক করছে।এই ভাবে ঘণ্টা দেড়েক চলার পর দুপুর ২টো ২০তে ডেলোরমে জানালো আমরা সামিটে পৌঁছে গেছি।আমরা ৭জন আর সাথে দুই শেরপা ভাই বীরে আর নোরবু জি দেও টিব্বার শীর্ষে।সামিটে খুশি তে মেতে উঠলাম আমরা সবাই।আবার একে ওপর কে জড়িয়ে ধরলাম,ভারতের তিরঙ্গা,আরোহীর ফ্ল্যাগ  নিয়ে গ্রুপ ছবি তোলা হলো আবারও।আর দেরি করা যাবে না আবহাওয়া প্রচণ্ড ভয়ানক হয়ে উঠেছে।স্নো ফল এত পরিমাণে হচ্ছে যে আমাদের ওপরে উঠে আসা ফুট স্টেপ গুলো মিনিটের মধ্যে ঢেকে যাচ্ছে।এদিকে হাওয়ার গতিবেগ প্রায় ৪০থেকে ৫০কিলোমিটার বেগে চলছে।বরফের ঝর মুখে যেনো চর মারতে লাগলো।কোনোমতে একটা হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে  হোয়াইট আউটের মধ্যে পুরোপুরি অন্ধের মতো নিচের দিকে নামতে থাকলাম।একটা সময় একটা ঢালের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।বুঝলাম আমরা সম্পূর্ণ ভুল পথে নামছি।ওপরে উঠে আসার রোপ টাও খুঁজে পাচ্ছি না।কলকাতা থেকে রাহুল দা আর দীপাঞ্জন দা ডেলোরমে তে আমাদের ওপরে উঠে আসা ট্র্যাক রেকর্ড দেখে পথ নির্দেশ দিতে থাকলো ম্যাসেজ এর মাধ্যমে।একটা সময় আমরা ক্লান্ত হয়ে গোল করে দাড়িয়ে পড়লাম।শরীর ঠাণ্ডা হতে থাকলো।মাথায় তখন একটাই চিন্তা আমরা আজকে নামতে পারবো তো।আজ রাত টা বোধয় বিভক করে থাকতে হতে পারে।এদিকে ঠান্ডায় হাতের আঙুলেও কোনো সার নেই।ওদিকে বীরে আর নোরবু জি নিচে নামার রাস্তা খুঁজে চলেছে।আমরা আবার এগোতে থাকলাম।স্নো ঝর থামার ও কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।এই করতে করতে ৬টা বেজে গেলো।ওয়েদার হালকা করে ঠিক হলো। আশার আলো কথা টা শুনেছি বহুবার কিন্তু সেদিন বুঝলাম একেই বলে আশার আলো দেখতে পাওয়া।চোখের সামনে নিচে দেখা গেলো সেই ধুয়াঙ্গণ কল।
ফুরসেম্বা জি ওয়াকি তে জানালেন আমরা একদম ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।কাছাকাছি জায়গা তেই নিচে নামার রোপ টা পেয়ে যাবো আমরা।হঠাৎ নোরবু জি আওয়াজ দিল মিল গেয়া, রোপ মিল গিয়া।প্রাণে জল ফিরে পেলাম।শুরু হলো খুব সাবধানে নিচে নামা। সন্ধ্যে তখন ৮টা ১৫ আমরা ক্যাম্প ২ তে ফিরলাম।ওদিকে সুলডিম জি বেস ক্যাম্পে থাকা আমাদের ৪সদস্য কে নিয়ে ক্যাম্প ১এ উঠে এসেছে।আমাদের ওপরের খাবার ও প্রায় শেষের দিকে, তার মধ্যে ওপরের আবহাওয়া চরম রূপ ধারণ করেছে।সেদিন সারা রাত অনবরত স্নো ফল চলতে থাকলো।
       ১৮ই জুন সকালেও স্নো ফল থামলো না,এদিকে কলকাতা থেকে ডেলোরমে তে রুপাঞ্জন দা,রাহুল দা,কাকুলি দি,সাতি দি সবাই ওয়েদার আপডেট দিতে থাকলো ঘণ্টায় ঘণ্টায়।এরকম অবস্থায় সব ফেলে রেখে নিচে পালানো ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো রাস্তা রইলো না।সারাদিন স্নো বুট পরে সারাদিন বসে রইলাম টেন্ট এর ভিতর,একটু ওয়েদার ক্লিয়ার হলেই আমরা পালাবো নিচের দিকে।ওদিকে ক্যাম্প১ এও জানালো হলো যে আগামী ৩দিন আবহাওয়া এরকম ই ভয়ানক থাকবে তোমরা সুযোগ পেলে নিচে বেস ক্যাম্পে নেমে যাও।শুনলাম ওদের ক্যাম্প ১এ স্টোভ তুলতে ভুলে গেছে ওরা,সারারাত ৫জন না খেয়ে জলের কষ্টে রাত টা কোনরকম বহু কষ্টে কাটিয়ে পর দিন সকাল হতেই নিচে বেস ক্যাম্পে নেমে গেছে ওরা।আর আমরা ঠিক করলাম কাল সকাল হলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো ক্যাম্প ২থেকে।        
                 ১৯এ জুন সকাল হতেই সূর্যের ঝলমলে রোদ টেন্টের ওপর এসে পড়লো।এই সুযোগ আমাদের ঝটপট রেডি হয়ে নিচে পালাতে হবে।ফুরসেম্বা জানালো আর একটু অপেক্ষা করে যাই কারণ টেন্ট গুলো একটু না শোকালে ওদের বইতে কষ্ট হবে।ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমরা রেডি হয়ে গেলাম নিচে যাওয়ার জন্য।সেই সময় হঠাৎ সত্যরূপ দা জানালো দুটো আইস এক্স কাল দেও টিব্বার প্রথম এনকার পয়েন্ট এর কাছে রয়ে গেছে।ফুরসেম্বা আর বীরে ভাই ছুটলো সেটা আনতে।আর আমরা এদিকে নিজেদের মাল পত্র আর কিছু খাবার দাবার স্যাক এ ভরে ক্যাম্প ২ ছেড়ে স্নো ফিল্ড এর ওপর দিয়ে নিচে নামার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলাম।খানিক টা যাওয়ার পর শেষ বারের মতো পিছন ফিরে দেখে নিলাম ইন্দ্রাসন কে।আর দেও টিব্বার দিকে তাকাতেই দেখলাম বীরে ভাই আর ফুরসেম্বা জি ওপরের দিকে উঠছে আর ঠিক তার পাশের একটা গালি থেকে বিশাল এক এভালাঞ্চ নেমে গেলো।ঠাকুর কে মনে মনে ডাকলাম ওরা যেনো সুস্থ ভাবে নিচে নেমে আসতে পারে। চলতে চলতে একটা সময় আমরা আবার সেই ক্যাম্প ২তে উঠে আসা আইস 

ঘরে ফেরার পথে 

ওয়াল টার ঠিক মাথায় এসে দাড়ালাম। মুহূর্তের মধ্যে আবার হোয়াইট আউট ঢেকে দিল পুরো এলাকা টা।আমরা ১৩তারিখ এই রুট দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিলাম।এই ৭দিনের বরফে চাপা পড়ে থাকা রোপ খুঁজে বার করতে হবে আমাদের।চললো খোদাই অভিযান,এক কথায় চিরুনি তল্লাশি।ঠিক যেমন ভাবে চাষী ভাইরা মাঠে  কোদাল চালায়,আমরা বরফের ময়দানে আইস এক্স দিয়ে রোপ খুঁজতে লাগলাম।এদিকে পার্থ দা অনবরত হুইসেল বাজাতে থাকলো।যদি বীরে আর ফুরসেম্বা সেই হুইসেলের আওয়াজ পেয়ে আমাদের খুঁজে পান।এই করতে করতে ঘণ্টা খানেক কেটে গেলো,হোয়াইট আউটে অভ্জা দেখতে পেলাম দুজন পাহাড় সমান মাল পিঠে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। যাক ওরা দুজন ফিরেছে এবার নিশ্চই একটা সুরাহা হবে।এই ভাবতে ভাবতেই নৈতিক চেঁচিয়ে বললো পেয়ে গেছি,পেয়ে গেছি।
খুব সাবধানে রোপ ধরে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম আমরা, ঘণ্টা তিনেক এর মধ্যেই নেমে এলাম ক্যাম্প ১ এ।সেখানে পৌঁছে দেখলাম বেস ক্যাম্প থেকে সুলডিম জি আর সোনাম ভাই আমাদের জন্য ফ্লাক্স এ করে গরম গরম কফি এনেছে।খুব তৃপ্তি করে সেই কফি খেয়ে আমরা ধুয়াঙ্গণ কল থেকে নিচে নামা শুরু করলাম।
বিকেল ৫টা আমরা বেস ক্যাম্পে পৌছালাম।বেস ক্যাম্পে পৌঁছানো মাত্রই দারুন আতিতিয়েথা পেলাম।গরম কফি সাথে গরম গরম প্যানকেক।সেই রাত টা গল্প আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম।
     ২০এ জুন সারাদিন রেস্ট।চললো বেস ক্যাম্প গোছানোর কাজ।নিচে মিউল ওয়ালাদের খবর দেওয়া হলো কাল বেস ক্যাম্পে আমাদের নিতে আসার জন্য।রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে টেন্ট এ ঢুকে নিজেদের স্যাক গুছিয়ে নেওয়া হলো।
    ২১ জুন সকালে মিউল এলো একটু দেরিতে, সকলেরই তখন নিচে নামার তাড়া। ২১ দিন পর বাড়ির লোক গুলোর একটু গলাটা শোনার জন্য মন কেমন করছে প্রত্যেকেরই আর তার জন্য যেতে হবে সেই জগতসুখ ড্যাম এর কাছে। মনে হল যদি আমারও থাকত কোন ভূতের রাজার দেওয়া জুতো!!! শেষে বেলা তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছলাম জগৎসুখ ড্যাম। সেখানে দেখি চন্দন (চন্দন বিশ্বাস) আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।দেখা মাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আবেগে।একে একে সবাই এসে পৌঁছানোর পর গাড়িতে মালপত্র বোঝাই করে গাড়ি ছুটল মানালির দিকে। আবার সেই নীলকমল।
   মনের মধ্যে আনন্দ আর বিষাদ যেন সমান্তরাল ভাবে চলছে। একদিকে অভিযান সফল করে ঘরে ফেরার উত্তেজনা অপরদিকে নানা বয়সের নানা পেশার এতগুলো মানুষ যারা প্রত্যেকেই পাহাড় প্রকৃতির প্রেমে এক মাসের নামে ঘর ছাড়া। তাদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট মনকে আলোড়িত করছে। কোন বড় সফল অভিযানের নেপথ্যে অনেক মানুষের অবদান কাজ করে। আমাদের অভিযান ও তার ব্যতিক্রম নয়। সমতলে বসে প্রত্যেকেরই পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের নির্ঘুম রাত যেমন কেটেছে তেমনি পাহাড়ের অনেক উচ্চতায় বসেও চারজন মানুষ বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে আন্তরিক প্রার্থনায়। আমাদেরই দলের চার সদস্য   চৌধুরী (পিলুদা), জীবনদা, নবীন দা ও সাফিয়ার এদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ও সাহায্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে সমস্ত দুর্গমতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। ব্যক্তি নয় সমষ্টি বড় কথাটি বারবার প্রমাণিত।
           আমাদের এবার ঘরে ফেরার পালা। গল্প, আলোচনা, পরিকল্পনা সবই চলছে ফেরার পথে। পাহাড়ের হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব প্রায়। তাই আগামী বছর আবার কোথায় সেই ভাবনা নিয়ে মশগুল ১১ জন গৃহী সন্ন্যাসী। আপাতত বাড়ির বিছানা টানছে চুম্বকের মত। সবশেষে সেই দাঁড়িওয়ালা আলখাল্লা পড়া বুড়োকেই স্মরণ করে বলতে হয় "ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।"
                                                                                                                                                                         

Comments

Popular posts from this blog

ব্রহ্মকমল

HIMALAYA

MERA BHARAT MAHAN