ব্রহ্মা র স্মরণে আরোহীরা

আমরা সোনারপুর আরোহী, এবছর আমাদের অভিযান কাশ্মীরের মাউন্ট ব্রহ্মা(6416মিটার)। প্রাতঃস্মরণীয় ব্রিটিশ পর্বতারোহী স্যার বনিংটন  ১৯৭৩ সালে প্রথমবার মাউন্ট ব্রহ্মা ক্লাইম্ব করেন। সেই সফল আরোহনের ৫০ বছর পরে আমাদের ব্রহ্মা অভিযান। বিগত ৪৪ বছরে কোনো সফল অভিযান হয়নি মাউন্ট ব্রহ্মা পর্বতে। শুধু অভিযান নয়, আমরা ঐ পুরো অঞ্চলটা এক্সপ্লোর করবো, অভিযান শেষে কিব্বার নালা গ্রামের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার সামগ্রী প্রদান ও ঐ গ্রামে একটি মেডিকেল ক্যাম্প করবো,এই  হলো আমাদের মূল লক্ষ্য।


আমাদের টিম হলো 12 জনের

1) রুদ্র প্রসাদ হালদার(লিডার)

2) পার্থ সারথি লায়েক(ডেপুটি লিডার)

3) সত্যরূপ সিদ্ধান্ত(ম্যানেজার)

4) রুদ্র প্রসাদ চক্রবর্তী(ইকুইপমেন্ট ইনচার্জ)

5) নৈতিক নিলয় নস্কর

6) চয়ন চ্যাটার্জী(একাউন্টেন্ট)

7) অভীক মণ্ডল(কোয়াটার মাস্টার)

8) জয়দীপ হালদার

9) অসীম হালদার

10) উদ্দীপন হালদার(ডাক্তার)

11) তুহিন ভট্টাচার্য্য

12) দেবাশীষ মজুমদার


সাথে আমাদের 6 শেরপা বন্ধু,

1) ফুরসের্ম্বা শেরপা

2) নুরবু শেরপা

3) জাঙা বাহাদুর রাই

4) দাওয়া শেরপা

5) পাস ডুক্য শেরপা

6) তেনজিং শেরপা


সেই মতো, 30 এ জুন বেলা 11: 45 এ কোলকাতা স্টেশন থেকে আমরা রওনা দিলাম,স্টেশন এ আমাদের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল বহু শুভাকাঙ্খিরা। প্রায় দেড় হাজার কেজি মালপত্র সাথে নিয়ে জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস এ উঠে পড়লাম আমরা।

1 লা জুলাই সারাদিন ট্রেন এ কাটলো,জমিয়ে খাওয়া দাওয়া আড্ডার সাথে কখন যে কেটে গেলো গোটা দিনটা, বুঝতেই পারলাম না।

2 রা জুলাই আমরা সকাল সাড়ে 12টা নাগাদ জম্মু স্টেশন এ পৌঁছাই,জম্মু তে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আমদের 6 সেরপা ভাইরা। মালপত্র গাড়িতে তুলে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে আমাদের প্রায় দুপুর দেড়টা বেজে যায়, আমরা রওনা দিই কিস্তোয়ারের দিকে, মাঝে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম।

জম্মু থেকে কিস্তোয়ার 240 কিলোমিটার। 

কিস্তোয়ার পৌঁছালাম তখন রাত সাড়ে 8টা, ওখানে পৌঁছেই আমাদের জন্য ওখানে অপেক্ষা করছিল অভীক, জুনিয়ার দা,তুহিন আর আমাদের টিমের একমাত্র ডাক্তার উদ্দীপন। ওরা 4 জন  27 তারিখ অ্যাডভান্স টিমে কলকাতা থেকে রওয়ানা দিয়েছিল।কিস্তোয়ার এ লোকাল পারমিশন, সব্জি বাজার এসব কাজ এগিয়ে রাখার জন্য। এছাড়াও আমাদের সাথে যোগ দেয় কিস্তোয়ারের লোকাল 4 জন রভিন্দর, রাজু, ভানু আর তার ভাই। ওরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল। পৌঁছানো মাত্রই আমরা ওদের সাথে কাজে হাত লাগাই প্যাকিং এর।কারণ পরের দিনই সকালে আমাদের বেরোনো।

3 তারিখ সকাল কিস্তোয়ারের ডি এম অর্থাৎ ডি সি সাহেব আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন এবং আমাদের যেকোনো রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং "নেশা মুক্ত ভারত" এই বার্তা সাথে দিয়ে আমাদের বিদায় জানান। এই সব করে 11 টা নাগাদ তিনটে ছোট গাড়িতে মালপত্র তুলে রওনা দিলাম আমদের আজকের শেষ গাড়ির রাস্তা সৌন্দের গ্রামের (1860মিটার) উদ্দেশ্যে।কিস্তোয়ার থেকে সৌন্দের গ্রামের দূরত্ব প্রায় 70 কিলোমিটার। গ্রামটা অপূর্ব সুন্দর। সৌন্দের থেকে দুপুর তিনটের সময় রওনা দিলাম কিবারনালা গ্রামের উদ্দেশ্যে,সৌন্দের থেকে কিবার নালা গ্রামের দূরত্ব 9.5 কিলোমিটার। কিবারনালা গ্রামের উচ্চতা 2510 মিটার। কিবের নালা পৌঁছাতে আমাদের রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল , কারণ প্রচুর বৃষ্টির কারণে অনেকেই আটকে পড়েছিলাম।একে তে ঘুটঘুটে অন্ধকার জঙ্গল তার ওপর অঝোরে ঝড়ে চলেছে বৃষ্টি কোনো রকমে একটা পাথরের নিচে আশ্রয় নিলাম।সারা শরীর ভিজে স্নান।বৃষ্টি একটু কমাতে হেড টর্চের আলোয় । এখানে আমাদের সাথে আরো একজন যোগ দিল যার কথা না বললে গোটা অভিযান টাই বৃথা তিনি হলেন আমাদের টিমের একমাত্র কুক বইজ নাথ ঠাকুর। এতো কঠিন নামে বাবা আমরা ডাকতে পারবো না,তাই যে যার নিজের মতো করে ওর নাম দিলাম,কেউ বৈদ্য দা,কেউ বা বেদ নাথ দা,কেউ বা শুধু দাদা নামেই ডাকতে শুরু করলাম ওনাকে।বাকি ওর হাতের রান্না র কথা পরে বলছি।

4 তারিখ সকাল 9 টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম সেলামি'র(নমস্কার স্থল) ট্রানজিট ক্যাম্প 2 এর উদ্দেশ্যে। কিবারনালা থেকে সেলামির দূরত্ব 6 থেকে 7 কিলোমিটার, উচ্চতা 3200 মিটার। দুপুর 1 টার মধ্যে এখানে এসে দেখলাম এখানে ব্রহ্মা সরোবর যাত্রা দর্শনার্থীদের জন্য লঙ্গরখানা চলছে। আমাদের আজকের খাওয়া দাওয়া এখানেই। এখান থেকেই প্রথম ব্রহ্মাকে দেখা যায়। তাই এই জায়গার নাম স্থানীয়রা নমস্কারস্থল বা সেলামি দিয়েছে। 5,6 ও 7 তারিখ এখানে ব্রহ্মা দর্শনের জন্য প্রচুর দর্শনার্থী আসবে ব্রহ্মা সরোবরে। তাদের জন্য সরকার থেকে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে।

5 তারিখ সকাল 8 টায় আমরা বেস ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে বেরোলাম। কিন্তু বেস ক্যাম্প একটু এগিয়ে অর্থাৎ যেখানে আমাদের বেস ক্যাম্প হওয়ার কথা ছিল তার থেকে এগিয়ে আর একটু ওপর দিকে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অগত্যা আমাদের বেস ক্যাম্প থেকে ঠিক 3 কিলোমিটার আগে ট্রানজিট ক্যাম্প 3 (3630মিটার) করতে হয়।

6 তারিখ সকালে আমরা বেস ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেস ক্যাম্প যেখানে হওয়ার কথা ছিল প্রথমে, সেই জায়গার নাম সোনামার্গ, এটা একটা সুন্দর বুগিয়াল লাল, নীল, হলুদ ছোট ছোট ফুলে ঘেরা। প্রায় হাজারের ওপর ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।আমাদের শেরপা সর্দার ফুর্সেম্বা জানায় যে, বেস ক্যাম্প আরো একটু ওপরের দিকে হবে।সেটা হলো সনামার্গ টপ (স্থানীয় লোকেরা এই জায়গার নাম তাম্বকায়েন বলে)। এর উচ্চতা 4170মিটার। আজও বৃষ্টি আমাদের পিছন ছাড়লো না। তখনও আমাদের মিউল এসে পৌঁছায়নি। বৃষ্টিতে ভিজে পৌঁছোলাম বেস ক্যাম্প। দারুন সুন্দর একটা জায়গা, চোখের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে ব্রহ্মা।

7 তারিখ আমাদের রেস্ট ডে, বেসক্যাম্প সাজিয়ে গুছিয়ে নিলাম মনের মতো করে।করা হলো বেস ক্যাম্পের মন্দির, দুটো ডাস্টবিন- একটা বায়ো ডিগ্রেডেবল্ আর একটা নন-বায়ো ডিগ্রেডেবল্। সারাদিনই চললো বৃষ্টি আর সাথে কখনো কখনো ঝোড়ো হাওয়া। কাল আমাদের শেরপা ভাইরা ক্যাম্প 1 এর রুট ওপেন করতে যাবে, রাতের খাওয়া সেরে আড্ডা-গল্প ক'রে ঘুমোতে যেতে প্রায় 11 টা বেজে গেলো। সারারাত বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া আমাদের ঘুমোতে দিল না ঠিক মতো, কাল সকালে বেস ক্যাম্প পুজো দেবো আমরা।

8 তারিখ ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি পনেরো মিনিটের মতো বিরতি দেওয়ায় বেসক্যাম্প পুজোটা সেরে নিলাম। তারপর সেই যে বৃষ্টি নামলো, সারাদিন সারারাত অনবরত চললো বৃষ্টি। এদিকে আজই ভানু আর তার ভাই কিস্তোয়ার নেমে যাবে। দুপুরে ধোকার তরকারি, ডাল আর উচ্ছে-আলু ভাজা দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম। আর রাতের মেনু খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা সাথে এক্সট্রা পাওনা পাঁপড়  ভাজা। খাওয়া সেরে ঘুম দিলাম , সাথে একটাই পর্থনা করলাম, 'ভগবান কাল সকালে চোখ খুলেই যেনো আকাশ পরিষ্কার দেখতে পাই।'

9 তারিখ সারাদিন আবার সেই বৃষ্টি টানা চললো। দুপুরের খাওয়া সেরে টেন্ট এ এসে বসে বসে একঘেঁয়ে লাগছিল। ঠিক বিকেল তখন 5:45,  6 তারিখের পর সূর্য এই প্রথম দেখা দিল। সবাই খুব আনন্দে মেতে উঠলাম।সূর্য পুরোপুরি ডুবতে ডুবতে এখানে প্রায় সাড়ে 7 টা সাড়ে 8 টা বেজে যায়। অন্ধকার হওয়ার ঠিক আগে ঢুকে পড়লাম টেন্ট এর ভিতর।  আকাশ আজ পরিষ্কার, জ্বল জ্বল করছে নক্ষত্র, রাতে ঠান্ডা পড়বে বেশ। রাতের খাওয়া সেরে ঘুমাতে গেলাম। কাল শেরপা ভাইরা ক্যাম্প 1 এর রুট খুলতে যাবে।

10 তারিখ সকাল থেকেই ঝকঝকে আকাশ।এদিকে শেরপারা বেরিয়ে পড়লো ক্যাম্প 1 এর রুট ওপেন করতে। আমরাও চাউমিন খেয়ে লেগে পড়লাম কাজে। কাল আমাদের লোড ফেরি। প্রত্যেকে প্রায় 12-13 কেজি করে খাবার দাবার নিজেদের স্যাক এ ভরে নিলাম।এই কদিন টানা বৃষ্টিতে টেন্ট এর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিলো,পুরো টেন্ট আবার তুলে নতুন করে খাটালাম আমরা। শেরপারা ক্যাম্প 1 এ কিছু ইকুইপমেন্ট রেখে আসতে আসতে প্রায় তখন সন্ধে সাড়ে 6টা। ওরা এসে জানালো যে, উপরে প্রায় এক হাঁটুর  চেয়ে বেশি বরফ। এখন রাতের খাওয়া সেরে ঘুমাতে যাচ্ছি, দেখা যাক কাল সকালে কি হয়।

11 তারিখ সকাল 6 টায় ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে বেরোতে 8 টা বেজে গেলো। প্রায় 13 কেজি লোড নিয়ে ক্যাম্প 1 এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম 9 জন মিলে।আমরা সাউথ ওয়েস্ট ফেস ধরে ক্লাইম্ব করবো। আমরা যে গালিটা দিয়ে ক্লাইম্ব করবো তার পাশের গালিটা দিয়ে আগের দিন রাতে এভালাঁচ হয়েছে, সেই এভালাঁচ প্রোন এরিয়াটা ক্রস করে কিছুটা ছোট ছোট বোল্ডার পেরিয়ে একটা প্রায় 10 মিটারের ছোট রক ওয়াল টপকে আমাদের ক্রাম্পন পয়েন্ট এলো, সেখান থেকেই আমাদের রোপ শুরু। জুতোর নিচে ক্রাম্পণ লাগিয়ে নিলাম।প্রথমেই প্রায় 40 থেকে 50 ডিগ্রি গ্রেডিয়েন্ট। তাই শুধু সেলফ এনকার লাগিয়ে শুরু করলাম ওপরের দিকে ওঠা। আসতে আসতে সেই গ্রিডিয়েন্ট কখনো 60 ডিগ্রি তো কখনো 70 ডিগ্রি, এই ভাবে বাড়তে থাকলো। কখনো বরফ তো কখনো পাথুরে দেওয়াল। প্রথম হাম্পটা পার হতেই আমাদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেলো। তারপর সামনে আরো একটা প্রায় 70 ডিগ্রি ওয়াল এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছুটা হেঁটে রোপ এ জুমার লাগালাম। এবার শুরু হলো জুমার ঠ্যালা।একটা সময় উঠে এলাম ওয়ালটার ওপরে।তখন ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে, পৌঁছালাম ক্যাম্প 1 (4950মিটার) এ। পৌঁছেই দেখলাম আমাদের শেরপারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ব্যাগ থেকে সব খাবার একটা টেন্ট এর ভিতর রেখে, আধ ঘণ্টা মতো সময় কাটিয়ে, সোজা বেসক্যাম্পের দিকে নামা শুরু করলাম। দু'জন শেরপা আমাদের সাথে আজ বেসক্যাম্পে নেমে যাবে, বাকী 4 জন ওপরেই থাকবে,তারা ক্যাম্প 2 এর রুট ওপেন করতে যাবে। ক্যাম্প 1 থেকে বেসক্যাম্পে নামতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগলো। নিচের দিকে নামতে বেশি সময় লাগে না।

12 তারিখ আমাদের রেস্ট ডে, তাও আমরা ক্যাম্পে শুয়ে বসে সময় নষ্ট করিনি, এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলাম। বাকি যে দু'জন শেরপা কাল নেমে এসেছিল তারা আজ আবার কিছু মাল নিয়ে ওপরে গেলো।

13 তারিখ তিনজন শেরপা নিচে নেমে এলো। ওরা কাল আমাদের সাথে ক্যাম্প 1 অকোপায়েড করতে যাবে, তাই আজও আমাদের রেস্ট ডে।

14 তারিখ সকাল দশটা নাগাদ বেরোলাম ক্যাম্প 1 অকোপায়েড করতে। প্রথমদিকে আবহাওয়া বেশ ভালোই ছিল, আজ আগের দিনের থেকে রাস্তা অনেক কঠিন হয়ে গেছে।কারণ ক্যাম্প 1 যাওয়ার রাস্তায় বরফ গুলো বেশির ভাগ টাই গলে গেছে। তাই কিছু টা বরফ বেশির ভাগই রক ওয়াল এ পরিনত হয়েছে। পায়ে জুতোর নিচে কাঁটা লাগিয়ে রক এ ওঠাটা খুবই চাপের, তার ওপর আবহাওয়াও আসতে আসতে খারাপ হতে থাকলো। শুরু হলো বৃষ্টি, স্নোফল, আর সাথে প্রায় 40 থেকে 45 কিলোমিটার বেগে ঝড়। যাইহোক, কোনো রকমে একপ্রকার যুদ্ধ করে বিকেল 5 টায় ফিরলাম ক্যাম্প 1-এ। ফিরেই সবার আগে টেন্ট এ ঢুকলাম। কাঁপতে কাঁপতে ভিজে জামা কাপড় ছেড়ে বসতেই মিনিট পনেরো পরই আবার আকাশ ঝক ঝকে হলো। আজ রাতের খাবার টা তাড়াতাড়ি সেরে শুয়ে পড়লাম সবাই, কারণ কাল ক্যাম্প 2-এ জন্য বেরোতে হবে।

15 তারিখ সকালটায় ক্যাম্প 2 এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফুর্সেমবাজি জানালো এটাই আমাদের সামিট ক্যাম্প। বেশ অনেকটাই পথ, কিছু কিছু জায়গায় 60 থেকে 70 ডিগ্রি ক্লাইম্বিং। ক্যাম্প 2-তে (5532মিটার) পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল সাড়ে 4টে বেজে গেলো। খবর পাওয়া গেল আজ ওপরের ওয়েদার খুব ভালো। তাই টিম লিডার জানালো আজ রাতেই সামিট পুশ হবে। সেই মত সাড়ে ছ'টার মধ্যে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত 10 টায় উঠে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। সাড়ে 11 টায় আমরা 9 জন আর শেরপা 6জন বেরিয়ে পড়লাম সামিট এর উদ্দেশ্যে। টিম এর সবাই দারুন ফিট এবং চাঙ্গা। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কিছুটা এরিয়া কৃভাস জোন।টিমের এমন কেউ নেই যে কৃভাসে পড়েনি,কখনো এক হাঁটু,কখনো কোমর অব্দি কখনো বা বুক অব্দি বরফের ফাটলে ঢুকে যাই আমরা সবাই।তারপর 70 ডিগ্রি ওয়াল পেরিয়ে একটা কর্নিস এর ঠিক সামনে এসে দাড়ালাম, সেটা কে ট্রভার্স করে একটা ছোট্ট রিজের সামনে এসে পড়লাম, তারপর শুরু হলো আসল খেলা। একটার পর একটা ওয়াল কখনো 70 ডিগ্রি আবার কখনো সেটা 80 ডিগ্রি খাড়া ওয়াল। এইভাবে সারারাত ধরে চললো ক্লাইম্বিং। একটু বসে জল খাবো, সেই সুযোগটুকুও পাইনি আমরা। এই করতে করতে একটা সময় একটা কর্নিসের মাথায় এসে বসলাম তখন সময় সকাল 6টা। সেখান থেকে আমাদের সামিট আর মাত্র 300 মিটার মতো বাকি। শেরপারা তখন বাকি 200 মিটারের মতো রোপ ফিক্স করতে একটু এগিয়ে গেলো। আমরা ও আসতে আসতে এগোতে থাকলাম। এদিকে আবহাওয়া মারাত্মক খারাপ হতে থাকলো। চারদিক সাদা হোয়াইট আউট-এ গ্রাস করলো। সাথে প্রায় 20 কিলোমিটার বেগে হওয়া। তখন আমরা মাত্র 150 মিটার নিচে সামিটের থেকে। থমকে দাঁড়ালাম সবাই, কারণ শেরপারা ওপরে কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তিত বুঝতে পারছি। ওয়াকিটকিতে নেপালিতে সমানে কথা বলছে।হালকা আশঙ্কা হল নিশ্চই ওপরে কোনো বিপদ হয়েছে। ঠিক তাই। আমাদের এক শেরপাদাদা প্রায় 70 মিটার নিচে ক্রিভাস-এ পড়ে যায়। গুরুতর চোট পেয়েছে। রুদ্রদা জানালো শেরপারা ওকে উদ্ধার করতে লেগে পড়েছে তাই এই মুহূর্তে আমাদের নিচে নেমে যেতে হবে। শেরপারা তেনজিংকে উদ্ধার করে নিচে নিয়ে আসবে। আমরা আসতে আসতে ওই ব্লিজার্ড এর মধ্যে নিচে নামতে শুরু করলাম। পা ঢুকে যাচ্ছে হাঁটু অব্দি বরফে।কখনো পিছলে গিয়ে নেমে যাচ্ছি নিচের এনকার অব্দি। এই করতে করতে প্রায় দুপুর 12 টা নাগাদ ক্যাম্প 2 অর্থাৎ সামিট ক্যাম্পে এসে পৌঁছালাম। আজ 16 তারিখ, টিম মিটিং এ সিদ্ধান্ত হলো যে শেরপা ভাই আহত হয়েছে তাকে প্রথমে নিচের হাসপাতাল এ পাঠানো হবে। সাথে কিছু মেম্বার নিচে বেস ক্যাম্প এ চলে যাবে, আর একটা সামিটের চেষ্টা করা হবে টিম ছোট করে তিন চার জন মেম্বার নিয়ে।

17 তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি তেনজিং অনেকটাই সুস্থ স্নো ব্লাইন্ড হয়েছে, নাকে চোট লেগেছে, হাতে পায়ে ও হালকা চোট আছে। আমাদের সাথে ডাক্তার(উদ্দীপন) থাকায় ওর ট্রিটমেন্ট করতে পারলো কিছুটা। তেনজিং জানায়, "আমি একদম ঠিক আছি, এখানে রেস্ট নি, আপনারা আজ আবার সবাই মিলে আর একবার চেষ্টা করুন সামিটের।"

সেই মতো আবার প্ল্যানিং শুরু হয়। গোটা টিম আবার সামিট পুশ করবে আজ রাতে। বেস ক্যাম্প থেকে কিছু জিনিষ আনতে হবে। দুটো শেরপাকে নিচে পাঠানো হলো, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আনার জন্য। রাত 12 টায় আমরা 9 জন আর শেরপা 5 জন বেরিয়ে পড়লাম।

18 তারিখ সকাল দশটা পঁচিশে আরোহীর 9 সদস্য আর 5 শেরপা মাউন্ট ব্রহ্মার শীর্ষে।আমরা প্রথম ভারতীয় যাদেরকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মা তার শীর্ষে আরোহণ করতে দিলেন। ক্যাম্প 2 তে ফিরতে ফিরতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা সাতটা হয়ে গেলো।

19 তারিখ দুপুর সাড়ে 11 টায় বেরোলাম বেস ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত 9 টা বেজে গেলো।

20 তারিখ সকাল থেকে আমাদের ফেরার প্রস্তুতি চললো। এছাড়াও সারাদিন চললো আরও নানান কাজকর্ম।

এবার ফেরার পালা।

21 তারিখ সকাল 9 টায় বেরোলাম বেস ক্যাম্প থেকে। আজকের গন্তব্য আমাদের সেই কিবের নালা গ্রাম।রাতে আমাদের মাথা গোঁজার অস্থানা টা হলো আমাদের সেই প্রিয় কুক বইজ নাথ দার বাড়িতে।দুদিন আমরা ওখানেই থাকবো। কাল ওখানে আমাদের অনেক কাজ। সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরোলাম। বেস ক্যাম্পে আসার সময় যে সুন্দর রাস্তা গুলো আমরা পেয়েছিলাম সে গুলোই ফেরার সময় ভয়ংকর সুন্দরে পরিণত হয়েছে।ছোট ছোট নালা গুলো প্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে বৃষ্টির কারণে।সে গুলো পার করে ওপারে যাওয়া মানে এটাও একটা সামিট পুসের মত মনে হচ্ছে।কোনো কোনো জায়গায় পিঠের স্যাক খুলে আগে সেটাকে ছুড়ে ওপরে পাঠাতে হচ্ছে পরে নিজে লাফিয়ে সেই খরস্রোতা নালা অতিক্রম করতে হচ্ছে।এরকমই একটা নালা তে অভিকের ব্যাগ টা ভেসে চলে যেতে থাকে।কিছুটা গিয়ে একটা ছোট্ট পাথরে গিয়ে ব্যাগ টা আটকে যাওয়ায় সে যাত্রায় ফিরে পায় অভীক তার পিঠের স্যাক টা।পুরো রাস্তা ভিজে স্নান করে ঠান্ডায় কাপতে কাপতে সারাদিন না খেয়ে যখন কিবের নালা গ্রামে ক্লান্ত দেহ টা নিয়ে কোনো রকমে টলতে টলতে যখন পৌঁছাই তখন রাত দেড়টা।

22 তারিখ সারাদিন চললো কিববের গ্রামের বাচ্চাদের পড়াশোনার সামগ্রী বিতরন। গ্রামের সবার জন্য সব রকম অসুখের ওষুধপত্র, আমাদের টিমের ডাক্তার উদ্দীপন প্রায় 80 জনকে চেকআপ করে ওষুধ দিল। আজ দুপুর এবং রাত দু'বেলাই গ্রামে একজনের বিয়েতে আমাদের সবার নিমন্ত্রণ। জমিয়ে খাসির মাংস আর ভাত খাওয়া হলো।

23 তারিখ সকালে আবার সেই একই জঙ্গলের পথে সৌন্দের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সৌন্দের গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে আর্মি চেক পোস্ট এ আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের এইভাবে সংবর্ধনা দেবে সেটা স্বপ্নের মতো লাগলো। সাথে ছিল চা,স্নাকস। একটা ইন্ডিয়ান আর্মির মেমেন্টোও দেওয়া হলো আমাদের।

সবে তো শুরু, আরো অনেক চমক অপেক্ষা করছিল টিম আরোহীর জন্য। আর্মি ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সৌন্দের গ্রামে ঢুকতেই দেখি গোটা গ্রামবাসী আমাদের জন্য হাতে ফুলের মালা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। গ্রামবাসীরা খুব খুশি আমাদের পেয়ে।

এবার সময় এসেছে সৌন্দের গ্রামকে বিদায় জানানোর। গাড়িতে মালপত্র তুলে রওয়ানা দিলাম কিস্তোয়ারের পথে। রাস্তায় কোনো খাবার না পেয়ে চিপস, বিস্কুট, চা, ডিমের অমলেট এসব খেয়ে মজা করতে করতে আর গান শুনতে শুনতে সন্ধ্যে 7 টায় পৌঁছালাম কিস্তোয়ার।

24 তারিখ কিস্তোয়ারের ডি সি সাহেব আমাদের জন্য বিশাল আয়োজন করলো, সাথে প্রেস কনফারেন্স এর ব্যবস্থা করলো।ডিসি সাহেবের এই আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হলাম।

25 তারিখ আমাদের বাড়ি ফেরার পালা। আজ আমরা জম্মু যাবো। রাত সাড়ে আটটায় আমাদের ট্রেন। একদিকে বাড়ি ফেরার আনন্দ আর অন্যদিকে পাহাড় ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। একদিকে মায়ের কোলে মাথা রেখে শোবার টান, অন্যদিকে প্রকৃতি মা'কে ছেড়ে যাওয়ার ব্যথা।

তবে কিস্তোয়ার, সৌন্দের, কিবের... তোমাদের কোনোদিন ভুলবো না। এই দেখাই শেষ দেখা নয়। আমরা আবার ফিরে আসবো।

Comments

Popular posts from this blog

ব্রহ্মকমল

HIMALAYA

MERA BHARAT MAHAN